নানানরকম স্বাদে, রূপে, রসে ও গন্ধে ভরা দেশ ভারতবর্ষ। এককথায় বলতে গেলে
শিল্প-সংস্কৃতি, তথা নান্দনিকতার পীঠস্থান এই দেশ। তাই বহু প্রাচীনকাল
থেকেই বিভিন্ন রকম সংস্কৃতির চর্চা এখানে হয়ে এসেছে। তারই একটি অঙ্গ হলো
লোকশিল্প। লোকশিল্প, অর্থাৎ লোকের শিল্প। এখন প্রশ্ন আসবে যে, সব শিল্পই তো
লোকের, এতে আলাদাটা কি আছে! আসলে লোকশিল্প হয় মাটির কাছাকাছি, তাতে
প্রকৃতির উন্মুক্ততার স্বাদ খুব ভালোভাবে প্রকাশ পায়। ভারতবর্ষের এইসমস্ত
লোকশিল্পগুলির মধ্যে এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য লোকশিল্প হলো আল্পনা।
আল্পনা কি? একেবারে এককথায় বলতে গেলে আল্পনা হলো
দ্বিমাত্রিক লেপিত কারুকার্য, সাধারণত একটি বা দুটি রঙের সহজ বিমূর্ত
রেখাচিত্র। শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কিছু পন্ডিত মনে
করেন আল্পনা শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ 'আলিমপনা' থেকে, যার অর্থ
প্রলেপ দেওয়া। আবার কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত
শব্দ 'আলিপনা' থেকে, যার অর্থ বাঁধ দেওয়া বা ঘেরা।
কোনো প্রাচীন শিল্প বিষয়ক গ্রন্থে আল্পনার উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে কিছু কিছু সংস্কৃত গ্রন্থে রঙ্গবলীর উল্লেখ আছে, যার অর্থ হলো রং দিয়ে প্রস্তুত করা লতানো নকশা। এই বর্ণনা থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে আল্পনার সকলপ্রকার বৈশিষ্ট্য উপস্থিত না থাকলেও রঙ্গবলী একপ্রকার আল্পনাই ছিল।
এই শিল্পের কাল নিরূপন করা বেশ কঠিন। অনেক পন্ডিতই একে প্রাক-আর্যকালের শিল্প বলে চিহ্নিত করেন। ভারতীয় কলা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সুপন্ডিত আনন্দকুমার স্বামী বলেন,"আল্পনা কলা বেঁচে আছে, তা অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগেকার কলা থেকে সাক্ষাতভাবে এসেছে"। ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত বলেন যে গোল আল্পনা চিত্রের মাঝখানে বাংলাদেশের পল্লী-রমণীরা যে পদ্মফুলের ছবি আঁকেন, তা মহেঞ্জোদারোতে ব্যবহৃত পদ্ম-নকশারই পরবর্তী ধারা। আবার বেশ কিছু পন্ডিত মনে করেন যে এই শিল্প এসেছে অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে, যারা আর্যদের আগমনের বহু পূর্বে এইদেশে বসবাস করত। এঁরা মনে করেন, আল্পনার মতন ধর্মীয় আচারসম্বলিত লোকশিল্পগুলি মূলত সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
এবারে আসা যাক এই শিল্পের স্থান এবং উপাদানের ব্যাপারে। এটি মূলত দ্বিমাত্রিক, এবং তা প্রধানত মেঝেতেই অঙ্কন করা হয়। মূল উপাদান খড়িমাটি, তা গুলে নিয়ে অনামিকা আঙুল দিয়ে অঙ্কন করা হয়। তবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে তাল মিলিয়ে ফেব্রিক রং ও এর উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভারতবর্ষে স্থানবিশেষে আল্পনা বিভিন্ন নামে পরিচিত। গুজরাটে এর নাম 'সাথিয়া', মহারাষ্ট্রে এর নাম 'রঙ্গোলি'। সন্ধ্যার সময়ে প্রদর্শনের জন্য অঙ্কিত হয় বলে উত্তরপ্রদেশে এর নাম 'সাঞ্ঝি'। রাজস্থানে আবার এটি 'মন্দানা' নামে সুপরিচিত।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে নাচোল উপজেলার একটি গ্রামের নাম টিকইল। এই গ্রামটি আল্পনা গ্রাম নামে বিখ্যাত। এই গ্রামের প্রত্যেকটি দেওয়াল যেন আল্পনার ক্যানভাস, এবং বংশপরম্পরায় গ্রামের গৃহিণী এবং মেয়েরা এই শিল্পকর্মের কারিগর। এখানে বর্তমানে আল্পনার উপাদান হলো শুকনো বরই চূর্ণ আঠা, আমের পুরোনো আঁটির শাঁসের গুঁড়ো, গিরিমাটি, চকগুঁড়ো, বিভিন্ন রং, এবং মানকচু ও কলাগাছের রস দিয়ে তৈরি মিশ্রণ। এটি অন্তত পাঁচদিন ভিজিয়ে রাখার পর তা দিয়ে আল্পনা আঁকা হয়, এবং এটি বর্ষব্যাপি স্থায়ী হয়। তাঁদের মতে এতে যেমন বাড়িতে পবিত্রতা আসে, তেমনি সকলের মনেও আনন্দের উদ্ভব হয়।
আধুনিক যুগের আল্পনা শান্তিনিকেতনী শৈলীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এই শৈলীর প্রবক্তা এবং ধারক ও বাহক হলেন শ্রী সুধীর রঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এই শৈলীর আলপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিমূর্ত, আলংকারিক, এবং ধর্মনিরপেক্ষ। এর স্বাতন্ত্র্য একে এক সূক্ষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। যদিও বিভিন্ন প্রজন্মের চিত্রকরদের সুবিধার্থে আল্পনার উপস্থাপনা ব্যাপকভাবে যুগের প্রচলিত রীতিতে মূর্ত হয়েছে, তা সত্ত্বেও যুগে যুগে আল্পনা তার ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সর্বতোভাবে সক্ষম।
কোনো প্রাচীন শিল্প বিষয়ক গ্রন্থে আল্পনার উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে কিছু কিছু সংস্কৃত গ্রন্থে রঙ্গবলীর উল্লেখ আছে, যার অর্থ হলো রং দিয়ে প্রস্তুত করা লতানো নকশা। এই বর্ণনা থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে আল্পনার সকলপ্রকার বৈশিষ্ট্য উপস্থিত না থাকলেও রঙ্গবলী একপ্রকার আল্পনাই ছিল।
এই শিল্পের কাল নিরূপন করা বেশ কঠিন। অনেক পন্ডিতই একে প্রাক-আর্যকালের শিল্প বলে চিহ্নিত করেন। ভারতীয় কলা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সুপন্ডিত আনন্দকুমার স্বামী বলেন,"আল্পনা কলা বেঁচে আছে, তা অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগেকার কলা থেকে সাক্ষাতভাবে এসেছে"। ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত বলেন যে গোল আল্পনা চিত্রের মাঝখানে বাংলাদেশের পল্লী-রমণীরা যে পদ্মফুলের ছবি আঁকেন, তা মহেঞ্জোদারোতে ব্যবহৃত পদ্ম-নকশারই পরবর্তী ধারা। আবার বেশ কিছু পন্ডিত মনে করেন যে এই শিল্প এসেছে অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে, যারা আর্যদের আগমনের বহু পূর্বে এইদেশে বসবাস করত। এঁরা মনে করেন, আল্পনার মতন ধর্মীয় আচারসম্বলিত লোকশিল্পগুলি মূলত সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
এবারে আসা যাক এই শিল্পের স্থান এবং উপাদানের ব্যাপারে। এটি মূলত দ্বিমাত্রিক, এবং তা প্রধানত মেঝেতেই অঙ্কন করা হয়। মূল উপাদান খড়িমাটি, তা গুলে নিয়ে অনামিকা আঙুল দিয়ে অঙ্কন করা হয়। তবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে তাল মিলিয়ে ফেব্রিক রং ও এর উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভারতবর্ষে স্থানবিশেষে আল্পনা বিভিন্ন নামে পরিচিত। গুজরাটে এর নাম 'সাথিয়া', মহারাষ্ট্রে এর নাম 'রঙ্গোলি'। সন্ধ্যার সময়ে প্রদর্শনের জন্য অঙ্কিত হয় বলে উত্তরপ্রদেশে এর নাম 'সাঞ্ঝি'। রাজস্থানে আবার এটি 'মন্দানা' নামে সুপরিচিত।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে নাচোল উপজেলার একটি গ্রামের নাম টিকইল। এই গ্রামটি আল্পনা গ্রাম নামে বিখ্যাত। এই গ্রামের প্রত্যেকটি দেওয়াল যেন আল্পনার ক্যানভাস, এবং বংশপরম্পরায় গ্রামের গৃহিণী এবং মেয়েরা এই শিল্পকর্মের কারিগর। এখানে বর্তমানে আল্পনার উপাদান হলো শুকনো বরই চূর্ণ আঠা, আমের পুরোনো আঁটির শাঁসের গুঁড়ো, গিরিমাটি, চকগুঁড়ো, বিভিন্ন রং, এবং মানকচু ও কলাগাছের রস দিয়ে তৈরি মিশ্রণ। এটি অন্তত পাঁচদিন ভিজিয়ে রাখার পর তা দিয়ে আল্পনা আঁকা হয়, এবং এটি বর্ষব্যাপি স্থায়ী হয়। তাঁদের মতে এতে যেমন বাড়িতে পবিত্রতা আসে, তেমনি সকলের মনেও আনন্দের উদ্ভব হয়।
আধুনিক যুগের আল্পনা শান্তিনিকেতনী শৈলীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এই শৈলীর প্রবক্তা এবং ধারক ও বাহক হলেন শ্রী সুধীর রঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এই শৈলীর আলপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিমূর্ত, আলংকারিক, এবং ধর্মনিরপেক্ষ। এর স্বাতন্ত্র্য একে এক সূক্ষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। যদিও বিভিন্ন প্রজন্মের চিত্রকরদের সুবিধার্থে আল্পনার উপস্থাপনা ব্যাপকভাবে যুগের প্রচলিত রীতিতে মূর্ত হয়েছে, তা সত্ত্বেও যুগে যুগে আল্পনা তার ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সর্বতোভাবে সক্ষম।
তথ্যসূত্র:
আল্পনা- বাংলাপিডিয়া
''Folk Art of Bengal'' - অজিত মুখার্জী
"The Living Tradition of Folk Arts in Bengal" - গুরুসদয় দত্ত
ব্লগের আল্পনাটি এঁকেছেন শ্রী শর্মিল সেন, আমার বাবা!
Comments
Post a Comment