শিল্প : খায়, না মাথায় দেয়?


 যেকোনো শিল্প সমালোচক কোনো একটি শিল্পের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি মাথায় রাখেন তা হলো শিল্পের কাঠামো সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব নির্ণয়। এই তত্ত্ব নির্ণয় করতে গিয়ে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মাথায় আসে, তা হলো যে শিল্প বিষয়টা আদতে কি? আবার শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে মূলত দুটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, প্রথমত, শিল্পের কাজ কি, আর দ্বিতীয়ত, শিল্পের সৃষ্টি কিভাবে হয়। এদুটি প্রশ্নের উত্তর যদি একসাথে সাজাতে পারি, তাহলে শিল্পতত্বের একটা সুসংহত কাঠামো নির্ণয় সম্ভব।
 তাহলে এই দুটি প্রশ্নের সহজ কিছু উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করা যাক। প্রথম যে প্রশ্ন, তা হলো শিল্পের কাজ কি? আমরা জানি যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মূলত তিনটি জিনিস প্রয়োজন - খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। এইগুলি পাওয়ার জন্য মানুষ সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে নিরলসভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এ তো মূলত অস্তিত্ব রক্ষা করার লড়াই, ডারউইনের ভাষায় 'Struggle for Existence'। এখানেই আমাদের মনে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, যে প্রথাগত ভাষায় যা শিল্প, অর্থাৎ নন্দনতত্ব বা 'Aesthetics'' এর প্রয়োজনীয়তা তাহলে ঠিক কোথায়? নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে করতেই মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত, সেখানে নন্দনতত্বের চিন্তাভাবনা করার সময় কোথায়? ডারউইন তাঁর "Origin of Species' বইয়ের মাত্র তিনটি পাতা জুড়ে একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যা শুধু মানুষের নয়, সমগ্র প্রাণীকুলের বিবর্তনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিষয়টি হলো সেক্স। ডারউইন বংশবৃদ্ধিকে বিবর্তনের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বংশবৃদ্ধির সংগ্রামও একপ্রকার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই তো বটেই। এখন এই লড়াইয়ের সাথে নন্দনতত্ব বেশ গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। বংশবৃদ্ধির সময়ে সঠিক সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নন্দনতত্ব হলো এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ Non-physical হাতিয়ার, যা একটি প্রাণীকে আর একটি প্রাণীর প্রতি আকৃষ্ট হতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র মানুষ নয়, বৈজ্ঞানিকদের মতে কোকিলের কুহুতান, ময়ূরের পেখম, ইত্যাদি সবকিছুই কিন্তু শিল্পের অংশ, এবং সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ Non-physical হাতিয়ার। সুতরাং বংশরক্ষার লড়াইতে মানুষ তথা প্রাণীকূলকে সহায়তা প্রদান করাই হলো শিল্পের মূল কাজ।
 তবে এটা তো গেল বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। যদি তাত্ত্বিক দিক থেকে বিষয়টি চিন্তাভাবনা করা যায়, তাহলে শিল্পের প্রাথমিক কাজ হলো আনন্দদান, মানসিক শক্তি তথা সৌষ্ঠব বিকাশ এবং সংগ্রামে সাহায্য করা, সর্বোপরি একটা সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা, যা আদতে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের কাছে অত্যন্ত আরামদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী যে প্রশ্নটি আসে, তা হলো শিল্প কিভাবে সৃষ্টি হয়? অধিকাংশ শিল্পী এবং তাত্ত্বিকগণ মনে করেন যে শিল্পসৃষ্টির মূল উপাদান হলো আবেগ বা অনুভূতি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে শিল্পের মূল উপাদান হলো রস। আবেগ বা অনুভূতি কখনোই আর্টের সরাসরি উপাদান হতে পারে না, কারণ তারা তাদের মূল অর্থাৎ আদিম অবস্থায় সৃষ্টিশীল নয়, সেখানে তারা লৌকিকজীবনের সাথে অতিমাত্রায় লিপ্ত। রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে আবেগ যখন লৌকিক জীবন থেকে এক পা সরে দাঁড়ায় তখন তা হয় রস। অনুভূতি এবং আবেগের মধ্যে যে সূক্ষ ব্যবধান আছে, তার জন্য আমারই অনুভূতি আমার ব্যক্তিগত বোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং তা আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে সম্পৃক্ত বলেই তাকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভবপর হচ্ছে।
 সুতরাং উপসংহার টানতে গেলে বলা যায় যে শিল্প হলো রস এবং খানিকটা আবেগ সম্বলিত পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতি আরামদায়ক এমন এক সৃষ্টি এবং এমন এক ক্ষমতা, যা মানুষের তথা প্রাণীকুলের সার্বিক বিকাশের সাথে সাথে বংশবৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা করে। সুতরাং হেডলাইন অনুযায়ী শিল্প খায়ও না, মাথায়ও দেয় না, আবার উভয় কর্মের মাধ্যমেই তার বিকাশ লাভ সম্ভব হয়, এককথায় বললে উভয়েই পরস্পর-নির্ভর। 


 তথ্যসূত্র:
                ''সমালোচক রবীন্দ্রনাথ'' - সৌরীন্দ্র মিত্র 
 ছবি : 
          ''The Starry Night'' - ভিনসেন্ট ভ্যান গগ

Comments