বাংলার ফোকলোর : বাউল



বাংলা ভাষাটা সত্যিই বহু পুরোনো ভাষা। সংস্কৃত থেকে এর উদ্ভব জানি, তবে ঠিক কবে এই পরিবর্তনটা সম্পন্ন হয়েছে, তা আমার মতন স্বল্পজ্ঞানী লোকের পক্ষে বলাটা খুব শক্ত। এখন এই বাংলা ভাষার প্রয়োজনটা শুধুমাত্র সংযোগ স্থাপনের জন্য, একথা বললে ভুল বলা হবে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়ে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এর তিনটি উদাহরণ দিতেই পারি -
১। চোদ্দ থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক ঘটনা, যা বাংলা ভাষার সূর্যোদয়ের সময়কাল।
২। ব্রিটিশ রাজের চক্রান্তে সংঘটিত ১৯০৫ সালের বাংলা বিভাজনকে প্রতিহত করা, যা মূলত বাংলা ভাষার জোরে।
৩। ১৯৭১ সালে মূলত বাংলাভাষায় ভর দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব-বাংলার মানুষের লড়াই।
           এই সমৃদ্ধ বাংলাভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বাংলা লোকসাহিত্যে, যা ফোকলোরের অন্যতম উপাদান। ছড়া, ধাঁধা, লোককাহিনীর মতো লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখা আছে, তবে লোকগীতিই অধিক সমৃদ্ধ। বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি প্রভৃতি গানগুলিই লোকগীতি। লোকগীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যে এগুলিতে গ্রামার কম, ফিল বেশি। আমাদের আলোচ্য বাউল গানে এই বৈশিষ্ট্য ভীষণভাবে প্রকাশিত।
             বাউল একটা সম্প্রদায় বা শ্রেণীর মানুষ। একটা সম্প্রদায়কে নির্দেশ করতেই এই শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। বাউল শব্দটা এলো কোথা থেকে, এবিষয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য যেটা, সেটা হলো এর উদ্ভব 'ব্যাকুল' বা 'বাতুল' থেকে। বাতুল অর্থাৎ পাগল। তৎকালীন নন-বাউল মানুষদের পক্ষে তাদের পাগল বলাটা ভীষণই স্বাভাবিক ছিল, কারণ এরা এককথায় মানুষপন্থী। এরা কোনো বিশেষ ধর্মকে আদর্শ বলে মনে করে না। এরা সর্বদা আপনভাবে বিভোর হয়ে থাকে; দেবদেবী, পুজো, মন্দির, মসজিদ চার্চ কিছুই মানে না; এরা নিজেদেরকে এইসবের উর্দ্ধে মনে করে। বাউলরা সাম্যপন্থী এবং উদার মানবতাবাদী হিসেবেই পরিচিত। এই মতবাদ সকলপ্রকার ভাবাবেগের উর্দ্ধে, স্বচ্ছ বস্তুবাদী এবং মানবতাবাদে বিশ্বাসী। এই মতবাদ সম্পূর্ণভাবে লোকজীবন থেকে উৎসারিত, সেখানে কোনোরকম কুসংস্কার এবং সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। তারা শাস্ত্র, জাতিভেদ, ঈশ্বর, পরলোক জন্মান্তর অগ্রাহ্য করে, তাদের সাধনভজনের মূল লক্ষ 'মানুষতত্ব'।
             তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনাকে বজায় রেখে যারা বৈষ্ণবধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল, তারা বৈষ্ণব সহজিয়া, বা রসিক বৈষ্ণব। মূলত চৈতন্য-পরবর্তী যুগে এই সম্প্রদায়ের প্রসার ঘটে। এর আবার দুটি শাখা ছিল। একটি শাখার প্রবর্তক ছিলেন আউলচাঁদ, আর অপর শাখার প্রবর্তক ছিলেন মাধববিবি। সম্ভবত বীরভদ্রের চেষ্টায় এই শাখা আরো ডালপালা মেলে ধরেছিল। এই শাখারই লোকপ্রচলিত নাম ছিল বাউল। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীতার জন্যই বোধহয় হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।
            মোটামুটি ১৬২৫-১৬৭৫ সময়কালকে বাউলতত্ত্বের উদ্ভবকাল হিসেবে ধরা হয়, যদিও এই সময়ে বাউল গানের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। মূলত লালন শাহই এই গানের প্রবর্তক। আবুল আহসান চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, " লালন তাঁর অতুলনীয় সংগীত প্রতিভা এবং তত্ত্বজ্ঞানের সমন্বয়ে বাউল গানের একটি স্বতন্ত্র ঘরানা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁকে বাউল গানের মহত্তম জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না "।
             বাউল দর্শন বাংলার লোকায়ত দর্শন। তাঁরা মনে করেন দেহেই 'মনের মানুষ' এর বাস। তাঁরা 'ভান্ডে করে ব্রহ্মান্ডের সাধন'। এই গানের রস সম্পূর্ণ ভাবে মানুষকে ঘিরে, যেখানে দেহকে ঘিরে বিভিন্ন প্রশ্ন, বিভিন্ন আকুতি উঠে এসেছে। যেমন, 'মন আমার দেহঘড়ির সন্ধান করি, কোন মিস্তরী বানাইয়াছে', কিংবা 'কে বলে মানুষ মরে, আমি বুঝলাম না ব্যাপার', কিংবা 'দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা'। এখানে রূপকের ব্যবহারও লক্ষণীয়, যেমন, 'গাড়ি চলেনা' কিংবা 'জল বিনে চাতকি মরিল'। আবার 'আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা, মধ্যে মধ্যে চরকা কাটা, তার উপরে সদর কোঠা, আয়না মহল তায়' এর মতন দেহের অপরূপ বর্ণনাও খুব স্পষ্টভাবেই লক্ষ করা যায়। এই সাধনা দেহতত্বের, এই তত্ত্বে কামকে কামের মধ্যে দিয়েই জয় করার সাধনা লক্ষণীয়, বলাই বাহুল্য পথপ্রদর্শক ছাড়া এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ খানিকটা অসম্ভবই বটে। তাই এই সাধনায় একজন গুরু প্রয়োজন। এই গুরু বাউলগানে 'সিরাজ সাঁই', 'মুর্শিদ' প্রভৃতি নামে পরিচিত। তাঁরা মনে করেন দেহের মধ্যেই গুরুর বাস, তাঁকে ধরার মধ্যে দিয়েই এই সাধনায় সিদ্ধি আসবে। তাই তো তাঁকে ধরতে গিয়ে বাউলদের মনে প্রশ্ন আসে, 'তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গিয়েও ধরা দেয় না', কিংবা , 'কেমনে চিনিব তোমারে, মুর্শিদ ধন হে'। শেষোক্ত গানটিতে বাউল শাহ আব্দুল করিম আকুতি করছেন বিভিন্নভাবে, যেমন 'কাছে নেও না দেখা দেও না, আর কত থাকি দূরে', কিংবা ' আমি তন্ত্র-মন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই, আর শাস্ত্র-যজ্ঞ পড়ি যত, আরো দূরে যেন সরে যাই'।
            বাউল সাধনায় নারী পূজ্যপাদ, তাঁরা একাধারে মা, আবার অন্যদিকে সন্তান উৎপাদক এবং সন্তান ধারক। এই তত্ত্বে নারী-পুরুষের ঊর্ধে গিয়ে সবাই মানুষ। বাউল গান লোকের গান, মাটির গান, প্রকৃতির গান। এই গানের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতিকে যেমন উপভোগ করা যায়, তেমনি মাটির কাছাকাছি থেকে একটা অসাম্প্রদায়িক, বিভেদহীন গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্নও দেখা যায়। এখানেই হয়তো এই সাধনতত্ত্বের সার্থকতা।

তথ্যসূত্র:
বাউল তত্ত্ব : আহমদ শরীফ

ব্লগের জন্য ছবিটি এঁকে দিয়েছেন বর্ষা ভৌমিক, আমার সব কাজের উৎসাহদাত্রী !

@#বর্ণ

Comments